Saturday, August 20, 2011

দলছুট

পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় ভেসে যাওয়া অনেক নীচের কলকাতা শহরটাকে দেখে মনে হল এক্ষুনি এই ব্যালকনি থেকে ঝাঁপ দিয়ে মরে গেলে কেমন হয়? ভাবতেই পায়ের নীচটায় কেমন শিরশিরিয়ে উঠল।
মৃত্যু আমি আমার জীবনে কম দেখিনি। পাড়া পড়শি, আত্মীয় স্বজন, রাস্তায় অচেনা কেউ এসব মিলিয়ে জনা দশেক তো হবেই। তবু রাত্রিদিন চোখের সামনে ঝিলমিলিয়ে ওঠা জীবনের মাঝে সহসা এই শূন্যতাকে এখনো গ্রহণ করে উঠতে শিখিনি। এখনো জীবনের সার্বিক অনুপস্থিতি, নিজের অস্তিত্বের গোড়া ধরে টান মারে, তুমি কি ভাব কোথা যাও, কিছু যায় আসে না শুধু দিনের শেষে ঘরে ফিরো মৃত হয়ে, এই তোমার নিয়তি।
যাঃ কি সব আজে বাজে ভাবছি, দাদা হলে বলত নেগেটিভ মেন্টালিটি। আর আমার মন তুমি কি বলবে? কি যুক্তি দেখাবে সাততলার ফ্ল্যাটের এই ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে হিমেল হাওয়ার ছোঁয়ায় এসব ভাবার? চার পেগের পর বিস্বাদযুক্ত পঞ্চম পেগ ভদকার এফেক্ট নাকি নিচে বয়ে যাওয়া এই অচেনা শহরটার গ্র্যাভিটি কেটে ওর কাছে ফিরে যাবার হাতছানি? আরেকবার প্লীজ আরেকবার খুব চেঁচিয়ে বলব শালা সব ফালতু কিছু হল না এ জীবনে।
কি হবে তাতে? কাল সকালে ফোন আসবে বসের? ও মিঃ লাহিড়ি উই হ্যাভ আ মিটিং ইয়েসটারডে, উই হ্যাভ ডিসাইডেড দ্যাট দেয়ার উইল বি নো জব টার্মিনেশন। কিচ্ছু হবে না, এ জীবনে আর কিচ্ছু হবে না, কালকে ও সূর্য উঠবে, অফিস যেতে হবে, জব টার্মিনেশনের পিঙ্ক স্লিপ নিয়ে বাড়ি ফিরতে হবে। দাদা ঠিক বলত, লাইফ ইস আ বিচ। সব তো দিয়েছি, ডিগ্রী, জব, টু বেডরুম ফ্ল্যাট, পাসপোর্টে ইউ এস এ এর ছাপ, দুটো ক্রেডিট কার্ড, ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স, সুন্দরী বউ, সে ঘরে না থাকলে সেক্সি অফিস কলিগ আজকের মত। তবে, তবে কি পেলে কুক্কুরীটা চুপ করে থাকবে কিচ্ছুক্ষনের জন্য?
বসার ঘরের সোফায় পরে আছে সুমির শরীরটা, সবুজ সালোয়ারে ঢাকা যেটাকে ঘন্টাখানেক আগে স্বচ্ছ সরোবরের মত মনে হচ্ছিল এখন এতক্ষন ধরে ঘাঁটার পর নিসুতো সেই শরীরটাকে পাঁকের মত বিশ্রী লাগছে, এই সুমির নগ্নতা, এর জন্য এতো দিন ধরে লুকিয়ে চুরিয়ে এক্সট্রা ম্যারিটাল, নিজের উপর ঘেন্নায় কেমন বমি পেল।বেসিনের দিকে এগোতেই খোলা বেডরুমের দরজা বেয়ে চোখে পড়ল জারটা। পিছনে একটা হাল্কা আলো লাগিয়েছে আমার বউ, জারটাতে ঘুরে যাচ্ছে নটা গোল্ডফিশ, আটটা লাল আর একটা কালো।
সকালে অফিসে ফোন করেছিল প্রিয়া, “এই শোন না, আজকে একটা জারে অনেকগুলো গোল্ডফিশ কিনেছি, আমি তো চলে যাব, রাতের বেলা ওদেরকে একটু খেতে দেবে সোনা হাতের মুঠোয় তখন সুমির নরম কোমরটা (এই এত্ত সরু, আর তখনো সবুজ সালোয়ারের নীচে)। ভালো করে শুনিওনি, রাতে তুমি থাকবে না এই সব, গোল্ডফিশ কেন আমি ব্ল্যাক প্যান্থারকে খেতে দিতেও রাজি।
পায়ে পায়ে জারটার সামনে এসে দাঁড়াতেই কালো গোল্ডফিশটা আমার সামনে এসে স্থির হয়ে দাঁড়াল, ইস খেতে দেওয়া হয়নি যে, মাছেরা কি খায়? দু ফোঁটা ভদকা ঢেলে দেব নাকি? মাছটা সামান্য এদিক ওদিক হেললো, এটা আবার আলাদা বাকিরা যখন সাঁতার কাটছে এটা চুপ কেন? আমি মনে মনে ওর নামকরন করলাম দলছুট।
জয়েন্ট এন্ট্রান্স, পার্থ, সায়ন্তন, অরিত্রা সবাই পেয়েছে, আমিও পেয়েছি, কিন্তু পরবো ফিল্ম ডিরেকশন, বার্গম্যান, কুরোশাওয়া, সত্যজিত, ঋত্বিক ছেড়ে ইলেকট্রিকাল কি যে বল আমি না দলছুট? তাই? যাদবপুর ইলেক্ট্রিক্যাল রোল নাম্বার ১৮৪ অনার্য লাহিড়ি।
আমি চাকরি করবো না, অনেক পরেছি এবার ব্যাণ্ড বিটলস, পিঙ্ক ফ্লয়েড বা মহীনের ঘোড়াগুলি, আবার দলছুটের স্বপ্ন। তাই? ইনফির লিস্ট বেরিয়েছে অনার্য খাওয়া, পাঁচে তুই।
কালো মাছটা আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল, নড়লো না চড়লো না, মদের খেওয়ালে মনে হল দলছুট অনার্য, একবারো মনে পড়ে শ্যামলা একটু মোটা মেয়েটার কথা, কি নাম ছিলো তার? ইনফির ট্রেনিং এ যাবার আগের সন্ধ্যায় কালভার্টের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল, সামান্য একটু ফুঁপিয়ে বলেছিল একবার বাবাকে বলে যা, আমি আর ওদের ছমাস ধরে রাখতে পারবো না, আর কেউ হলে আমি বলতাম না, তুই তো সবার মত নস, তুই তো... তুই তো আমার দলছুট
আজ আর মনে করতে পার তাকে? প্রিয়া, সুমি এদের পাশে সে? গোলপার্কে গিয়েও ভালো ইংলিশ বলে পারে না, স্মার্ট না, ট্যাটু নেই, ধুস নামটাই মনে আসে না। মরলে হয়তো আসত।
এই আমার ব্ল্যাকফিশ, এই আমার দলছুট, মরবি না, মরাটা হল এসকেপিসম, পালানো, আমি যদি এভাবে বাঁচি, তবে আমার বেডরুমে নীল আলোতে এত বড় জারে আরো আটজনের সাথে তুইও বাঁচবি, প্লীজ বাঁচবি, আজ বড্ড ঘুম পাচ্ছে, কাল অন্তত তোকে আমি খেতে দেব তুই দেখিস।
গুডনাইট দলছুট।
* * *
অনি অনি ওঠ, ইস কি করেছিস ঘরটাকে বমি করে তার উপরেই শুয়ে আছিস? ছিঃ যা গিয়ে পরিষ্কার হ।
ঘুম ভাঙে সুমির ডাকে, কালকের সবুজ সালোয়ারটা আবার চড়ে বসেছে, কাল রাতের আমার দেওয়া আবর্জনা ধুয়ে গেছে শাওয়ারে, চুলে ফিরে এসেছে শ্যাম্পুর ডাক, ঠোটে লিপস্টিকের কৃত্রিমতা। আবার সেই গন্ধটা মোহময়ী করে তুলেছে সুমিকে। আবার ফিরে এসেছে আমার অফিস কলিগ সুমি, কালকের সোফার উপর শুয়ে থাকা সুমিটা হারিয়েছে সালোয়ারের ভিতরে।
সুমি জারটার দিকে দেখে। এটা কি গোল্ডফিশ। ও ফেংসুই, তোর বৌ তো হোম মেকার রে, আটটা লাল একটা কালো। ও কালো টা মরে গেছে কাল রাতে, সেই জন্য তোর সুখবর আজ সকালে, তোর বৌকে একটা কিছু কিনে দিস
জারের দিকে তাকাতেই বুকের মধ্যে নিঃসীম শুন্যতাকে আবার টের পাই।জলের উপরে এখনো নিস্পন্দ ভাবে ভেসে আছে আমার দলছুট। মৃদু জলের স্পন্দনে জীবনের অনুপস্থিতি। নিচে আটটা লাল গোল্ডফিস নিজেদের মত করে জীবনের সুরে নৃত্যরত।
শোন, বস ফোন করেছিল, আমার উপর দায়িত্ব পড়েছে টার্মিনেশন লিস্ট বানানোর, সুইটহার্ট ইউ আর অন
কিছু কানে আসে না, শব্দ, বর্ন, গন্ধ মিলিয়ে গিয়ে ফুটে ওঠে ব্ল্যাক গোল্ডফিসটার মত শরীর। সুমি হাসে অকারনে গায়ে হেলে পড়ে তুই কি জানিস, কালো গোল্ডফিস মরার মানে হল তোর ব্যাডলাকটাকে শুষে নিয়ে ওটা মরে গেল
দলছুট মারা গেল, বেঁচে রইল সাধারন আর সাধারনত্বের চাপে ফসিল হয়ে যাওয়া আমিটা। সে উঠে আসবে, সুমিকে গভীর ভাবে চুমু খাবে, চাকরী করবে, আরো হারিয়ে যাবে জীবনের চোরাবালিতে।
আর সেই দলছুটটাকে ছেড়ে যাব জারের জলে, মৃতদেহের খোলসে।

No comments:

Post a Comment